রাশি ও একক কী?
এ মহাবিশ্বে যা কিছু পরিমাপ করা যায়, তা-ই হলো রাশি। যেমনঃ বস্তুর দৈর্ঘ্য, ভর, ওজন, সময় – এ বিষয়গুলো পরিমাপ করা যায়, তাই এগুলো রাশি। কিন্তু হিংসা, অহংকার, আনন্দ, বেদনা পরিমাপ করার মতো কোনো স্ট্যান্ডার্ড এখনো আবিস্কৃত হয় নি, তাই এ বিষয়গুলো পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় রাশি নয়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, রাশিকে পরিমাপ করার মতো স্ট্যান্ডার্ড থাকতে হবে। এ স্ট্যান্ডার্ডকে একক বা ইউনিট বলে।
দেশ বা স্থানভেদে একই রাশি পরিমাপের এ স্ট্যান্ডার্ড ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তাই তো এককের বিভিন্ন পদ্ধতি বা সিস্টেম আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমনঃ সি.জি.এস. পদ্ধতি, এফ.পি.এস. পদ্ধতি, এম.কে.এস. পদ্ধতি, এস. আই. পদ্ধতি প্রভৃতি।
মৌলিক ও লব্ধ রাশি
রাশি মূলতঃ দুই প্রকার – মৌলিক ও লব্ধ রাশি। যে রাশি প্রকাশ করার জন্য অন্য কোনো রাশির ধারণার প্রয়োজন হয় না, তাকে মৌলিক রাশি বলে। যেমনঃ সময়। সময় কী তা উপলব্ধি করার জন্য অন্য কোনো রাশি সম্পর্কে ধারণার প্রয়োজন নেই। তাই সময় একটি মৌলিক রাশি। সময় ছাড়াও আরো কতগুলো মৌলিক রাশি হলোঃ দৈর্ঘ্য বা দূরত্ব, ভর, তাপমাত্রা, পদার্থের পরিমাণ (মোলসংখ্যা) প্রভৃতি।
অপরপক্ষে, যে রাশি প্রকাশ করার জন্য বা উপলব্ধ করার জন্য অন্য এক বা একাধিক রাশির দ্বারা ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তাকে লব্ধ রাশি বলে। যেমনঃ দ্রুতি ও বেগ। দ্রুতি হলো একক সময়ে অতিক্রান্ত দূরত্বের পরিমাণ, অর্থাৎ দ্রুতি বুঝতে হলে আগে দূরত্ব ও সময় কী, সেটা বুঝতে হবে। তাই দ্রুতি একটি লব্ধ রাশি।
স্কেলার ও ভেক্টর রাশি
রাশিসমূহকে আরো একভাবে প্রকারভেদ করা যায়ঃ কোন রাশিগুলোর দিক আছে এবং কোন রাশিগুলোর দিক নেই – এর ভিত্তিতে। সময়, তাপমাত্রা, ভর – এসব রাশির ধারণায় এটা স্পষ্ট যে, এগুলো প্রকাশের জন্য কেবল মান প্রয়োজন, কোনো দিক প্রয়োজন নেই, তাই এগুলো হলো স্কেলার বা অদিক রাশি।
অপরদিকে, ওজন, বল – এসব রাশি প্রকাশের জন্য কেবল মান যথেষ্ট নয়, দিকও প্রয়োজন রয়েছে, তাই এগুলো হলো ভেক্টর বা দিক রাশি। মান একই রেখে দিক পরিবর্তন করা হলে এ রাশিগুলোর প্রভাব বা ফলাফল পরিবর্তন হয়ে যাবে।
যেমনঃ আমি যদি ১০ একক বল একটি স্থির বস্তুর ওপর পূর্ব দিকে প্রয়োগ করি এবং পরবর্তীতে যদি একইরূপ অপর একটি স্থির বস্তুর ওপর ১০ একক বল পশ্চিম দিকে প্রয়োগ করি, তাহলে নির্দিষ্ট সময়ান্তে (যেমনঃ ৫ সেকেন্ড পর) এরা সমান দ্রুতি ও গতিশক্তি অর্জন করবে ঠিকই (ঘর্ষণ ও শক্তিক্ষয় উপেক্ষা করে), কিন্তু প্রথম বস্তুর বেগ হবে পূর্বদিকে এবং দ্বিতীয় বস্তুর বেগ হবে পশ্চিম দিকে।
যেহেতু ফলাফল বা প্রভাব আলাদা, তাই মান একই (১০ একক) হওয়া সত্ত্বেও বল দুটি সমান নয়। এদের অসমান হওয়ার কারণ হলো, দিকের ভিন্নতা। সুতরাং বোঝা গেল, বল বা ফোর্স একটি দিক বা ভেক্টর রাশি। এরূপ আরেকটি ভেক্টর রাশি হলো বেগ।
এককের বিভিন্ন পদ্ধতি
পূর্বে একেক দেশে এককের একেক পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এককের এ পদ্ধতিগুলো হলো সি.জি.এস. পদ্ধতি, এফ.পি.এস. পদ্ধতি এবং এম.কে.এস. পদ্ধতি। এতে করে, এক দেশের লোক অন্য দেশে গেলে সেখানকার প্রচলিত একক ব্যবহার করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তো। তাই ১৯৬০ সালে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলন হয়, যেখানে পৃথিবীর সেরা পদার্থবিদ এবং রসায়নবিদরা মিলে একমত হোন যে, তখন থেকে সকল দেশে রাশির এককের একটি সাধারণ পদ্ধতি প্রচলিত থাকবে। এ পদ্ধতির নাম দেয়া হয় এস.আই.। এস.আই. (SI) মানে হলো সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল, বা এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি।
এ পদ্ধতিতে সাতটি রাশিকে মৌলিক রাশি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেগুলো হলোঃ দৈর্ঘ্য বা দূরত্ব, ভর, সময়, তাপমাত্রা, পদার্থের পরিমাণ, তড়িৎপ্রবাহ এবং দীপন তীব্রতা। এস.আই. পদ্ধতিতে এ রাশিগুলোর একক যথাক্রমে মিটার, কিলোগ্রাম, সেকেন্ড, কেলভিন, মোল, অ্যাম্পিয়ার এবং ক্যান্ডেলা।
নিচে বিভিন্ন পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মৌলিক রাশির একক ছকাকারে দেওয়া হলোঃ
এককের পদ্ধতির নাম | সি.জি.এস. | এফ.পি.এস. | এম.কে.এস. | এস.আই. |
---|---|---|---|---|
পদ্ধতির নামের পূর্ণরূপ | Centimeter Gram Second System | Foot Pound Second System | Meter Kilogram Second system | International System of Units |
দৈর্ঘ্যের একক | সেন্টিমিটার | ফুট | মিটার | মিটার |
ভরের একক | গ্রাম | পাউন্ড | কিলোগ্রাম | কিলোগ্রাম |
সময়ের একক | সেকেন্ড | সেকেন্ড | সেকেন্ড | সেকেন্ড |
উপর্যুক্ত ছক থেকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে, এস.আই. পদ্ধতিতে মূলতঃ এম.কে.এস. পদ্ধতিকে আত্মীকরণ করা হয়েছে। কারণ উভয় পদ্ধতিতে ভর ও দৈর্ঘ্যের একক একই।
দুঃখজনকভাবে, অনেক দেশে এখনো এস.আই. পদ্ধতি পুরোপুরি ইম্পলিমেন্ট করা হয় নি। যেমনঃ ইউ.এস.এ. বা আমেরিকাতে ভরের একক হিসেবে পাউন্ড এবং দৈর্ঘ্যের একক হিসেবে ফুট দেদারসে ব্যবহার করা হয়। সেখানে অধিকাংশ লোকই কিলোগ্রাম ও মিটারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একক ব্যবহার করতে অভ্যস্ত নয়। যে উদ্দেশ্যে এস.আই. পদ্ধতি চালু হয়েছিল, সেটা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় নি।
তড়িৎপ্রবাহের বদলে আধান
আমি মনে করি, তড়িৎ প্রবাহের পরিবর্তে আধান বা চার্জ মৌলিক রাশি হিসেবে পরিগণিত হওয়া উচিত। কারণ তড়িৎ প্রবাহ হলো কোনো পরিবাহীর প্রস্থচ্ছেদের মধ্য দিয়ে একক সময়ে অতিক্রান্ত আধানের পরিমাণ। সুতরাং তড়িৎ প্রবাহের সংজ্ঞা দিতে গেলে আধান ও সময়ের ধারণা আবশ্যক। অপরদিকে, আধানের সংজ্ঞা দেওয়ার সময় অন্য কোনো ভৌত রাশির অবতারণার প্রয়োজন নেই। সেকারণে, আমার মতে, তড়িৎ প্রবাহের বদলে আধানকে মৌলিক রাশি হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।